সুন্নাত আল্লাহর নাকি নবীর ?
“সুন্নাত আল্লাহর, মুহাম্মাদের নয়”—গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং কুরআনের আলোকে চিন্তা করলে এটি একদম ভিত্তিযুক্ত।
চলুন এই কথাটির মূল ব্যাখ্যায় যাই কুরআনের আলোকে:
📘 কুরআনের আলোকে "সুন্নাত"
✅ "সুন্নাতুল্লাহ" (سُنَّةَ اللَّهِ) — কুরআনে আছে বারবার
সুন্নাতুল্লাহ মানে:
আল্লাহর চালু বিধান, নিয়ম, বা কার্যপ্রক্রিয়া – যা কোনো জাতির উপর, সমাজের উপর, অথবা ইতিহাসে পুনরাবৃত্তভাবে ঘটে থাকে।
📌 উদাহরণ:
قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ...
“তোমাদের পূর্বে বহু ‘সুন্নাহ’ চলে গেছে...”
📖 (সূরা আলে ইমরান 3:137)
سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ
“আগের লোকদের মধ্যে এটাই ছিল আল্লাহর সুন্নাহ।”
📖 (সূরা আল-আহযাব 33:38)
✅ এখানে ‘সুন্নাহ’ মানে মুহাম্মদের কোনো অভ্যাস নয়, বরং আল্লাহর ঐতিহাসিক নিয়ম। যেমন:
-
যারা জুলুম করে, তাদের ধ্বংস করে দেন
-
যারা ঈমান আনে, তাদের সাহায্য করেন
-
যারা নবীদের অস্বীকার করে, তাদের জাতি ধ্বংস হয়
❌ "সুন্নাতুন্নবী" কুরআনের পরিভাষা নয়
-
কুরআনে “সুন্নাতুন্নবী” (নবীর সুন্নাহ) শব্দটি একবারও আসে না।
-
নবীকে বলা হয়েছে “উসওয়াতুন হাসানাহ” – অর্থাৎ উত্তম আদর্শ/আচরণ।
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
“তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”
📖 (সূরা আহযাব 33:21)
🟡 লক্ষ্য করুন: এখানে “উসওয়া” (আদর্শ), কিন্তু “সুন্নাহ” বলা হয়নি।
🔍 তাহলে “সুন্নাহ” শব্দটি হাদিসে যেভাবে ব্যবহৃত হয়, সেটা কুরআনের ব্যবহার নয়
-
হাদিস শরীফে “সুন্নাহ” শব্দের মানে হয়েছে:
-
নবীর অভ্যাস
-
তাঁর বলা/করা/সমর্থন করা কাজ
-
✅ মুসলিম ফুকাহা ও মুফাসসিররা পরবর্তীতে এটিকে “সুন্নাহ” নামে প্রতিষ্ঠা করেন, এবং ফিকহের উৎস বানান:
-
কুরআন
-
সুন্নাহ
-
ইজমা
-
কিয়াস
কিন্তু কুরআনে স্পষ্টভাবে সুন্নাহ বলা হয়েছে শুধু আল্লাহর নিয়ম বুঝাতে।
যারা আল্লাহ ও নবীর মাঝে পার্থক্য করে তারা কাফের” — এর পেছনে কুরআনের একটি আয়াত আছে, তবে এর বাস্তব ও ভাবগত বিশ্লেষণ জরুরি। ‘বিধান দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ’ — এটিই কুরআনের মূল মেসেজ।
📖 ১. আয়াতটি কোথা থেকে এসেছে?
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ...
“নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে এবং চায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মাঝে পার্থক্য করতে...”
📖 সূরা আন-নিসা (4:150-151)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে —
আল্লাহ ও রাসূলদের মাঝে বিভাজন করা, অর্থাৎ কেউ যদি বলে "আমি আল্লাহকে মানি, কিন্তু তাঁর রাসূলদের মানি না" — তারা কাফের।
⚠️ লক্ষ্য করুন:
-
এখানে "রাসূল" মানে শুধু মুহাম্মদ (সা.) না, সব নবী ও রাসূল (নূহ, মূসা, ঈসা, ইব্রাহিম...)।
أُوْلَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا ۚ
“এরাই প্রকৃত কাফের” — বলা হয়েছে পরের আয়াতে (4:151)।
⚖️ ২. তবে পার্থক্য মানে কী?
বিভিন্ন মুসলিম গোষ্ঠী আজ এই আয়াত দিয়ে বলে থাকে:
“তুমি যদি নবীর হাদিস, সুন্নাহ মানো না — তুমি কাফের!”
📌 কিন্তু আসল কুরআনিক প্রসঙ্গ হলো:
আল্লাহকে মানা আর নবীদের অস্বীকার করা একসঙ্গে চলে না।
এই আয়াত ঈসা (আ.)-কে অস্বীকার করা ইহুদিদের, কিংবা মুহাম্মদ (সা.)-কে অস্বীকার করা খ্রিস্টানদের প্রসঙ্গে বলা।
🛑 ৩. কিন্তু আজ যারা ‘নবী পূজা’ করছে, তারা কি আল্লাহ ও নবীর মাঝে বিভেদ করছে না?
চমৎকার প্রশ্ন!
আজ অনেকেই নবীকে এমনভাবে উচ্চ স্থানে বসাচ্ছে যে আল্লাহর স্থান পর্যন্ত ম্লান হয়ে যাচ্ছে:
-
“নবী না হলে কুরআন আসতো না”—এই বক্তব্যে আল্লাহর ক্ষমতাকে ছোট করা হয়।
-
“নবী ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না”—এটা আল্লাহর বিচারক্ষমতার বিরুদ্ধে।
-
“নবীর সুন্নাহ মানা ফরজ, কুরআন যথেষ্ট না”—এটা সরাসরি কুরআনের সাথে সংঘাত।
📌 এভাবে নবীকে বিধানদাতা, বা কুরআনের সমপর্যায়ে তোলা হলো আসল বিভেদ।
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ
“সৃষ্টি ও বিধানের অধিকার একমাত্র তাঁরই।”
📖 (সূরা আরাফ 7:54)
“নবী মানে আল্লাহর অনুসারী, না আল্লাহর সমপর্যায়ের আইনদাতা” — এই পার্থক্য বুঝতে না পারলে মানুষ ভুল পথে চলে যায়।
আল্লাহর বিধানই একমাত্র চিরন্তন ও বৈধ বিধান।
নবী বা কেউই বিধানদাতা নন — বরং বিধানের বাহক, ব্যাখ্যাকারী, পথপ্রদর্শক।
আল্লাহর এসব নিয়ম যে জাতি মানে না — তারা ধ্বংস হয়, যে জাতি মানে — তারা উত্থান লাভ করে।
এটাই সুন্নাতুল্লাহ।
"আল্লাহ তাঁর বিধানে কাউকে শরিক করেন না"—হুবহু কুরআনের আয়াত এবং একটি মূল তাওহিদের ভিত্তি। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর বিশ্বাস, যা কুরআন বহুবার বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ঘোষণা করেছে।
📖 মূল আয়াত:
"لَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا"
"তিনি তাঁর বিধানে কাউকে শরিক করেন না"
📖 সূরা কাহফ (18:26)
➤ শব্দ বিশ্লেষণ:
-
لَا يُشْرِكُ (la yushriku): তিনি অংশীদার করেন না
-
فِي حُكْمِهِ (fi hukmihi): তাঁর বিধানে, সিদ্ধান্তে, শাসনে
-
أَحَدًا (ahadan): কাউকে না
✅ অর্থ: আল্লাহ যখন কোনো বিধান দেন, সিদ্ধান্ত নেন বা শাসন চালান, সেখানে তাঁর সাথে কারো মত, ইচ্ছা বা অনুমতি লাগে না — কেউ তাঁর সঙ্গী হতে পারে না।
🧭 এর ভাবার্থ ও প্রভাব
✅ ১. শরিয়ত বা আইন কেবল আল্লাহর
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
"বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর"
📖 সূরা ইউসুফ (12:40)
🔹 কারো রেওয়ায়েত, হাদিস, তাফসির বা ইমামের কথা — কুরআনের বিরুদ্ধে গেলে, সেটি বাতিল।
🔹 নবী নিজেও কিছু বলেন না নিজ ইচ্ছায়:
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ • إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
"তিনি নিজের খেয়াল থেকে কিছু বলেন না, এটি তো ওহি মাত্র।"
📖 সূরা নাজম (53:3-4)
✅ ২. আল্লাহ কাউকে আইন বানানোর অধিকার দেননি
আজ মানুষ অনেক সময় ফিকহ, ইজমা, হাদিস, বা মাজারের পীরদের কথা দিয়ে ধর্মীয় বিধান তৈরি করে — অথচ আল্লাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন:
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ
“তাদের কি কিছু শরিক আছে যারা তাদের জন্য এমন বিধান করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?”
📖 সূরা আশ-শুরা (42:21)
🔴 এই আয়াত বলছে: কেউ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আইন বানালে, তারা শিরকের পর্যায়ে পড়ে যায়।
✅ ৩. নবী বিধানদাতা নন, বরং পৌঁছে দেন
مَّا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ
“রাসূলের কাজ কেবল বার্তা পৌঁছে দেওয়া”
📖 সূরা আল-মায়িদা (5:99)
🔹 কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিছু চূড়ান্ত বিধান হতে পারে না।
“আল্লাহ তাঁর বিধানে কাউকে শরিক করেন না” —
এটি কুরআনের ভিত্তি, তাওহিদের গভীরতম স্তর।
📌 তাই, সত্যিকারের মুসলিম মানে সেই ব্যক্তি:
-
যে কেবল আল্লাহর কিতাব থেকে হুকুম নেয়
-
যে জানে, নবী, ইমাম, হাদিস, ফতোয়া — কিছুই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বিধান হতে পারে না
সুন্নাত শব্দের রুট এবং কুরআনে এর বিশদ ব্যাখ্যা
🔹 "সুন্নাত" শব্দের রুট ও প্রকৃত অর্থ
"সুন্নাত" শব্দটি (سنة) মূলত আরবি "س-ن-ن" (سَنَّ - يَسُنُّ) ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ “নির্ধারিত পথ, নিয়ম, নীতি বা বিধান”।
👉 কুরআনে "সুন্নাত" শব্দটি সর্বদা আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, এবং এটি আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম বা পদ্ধতি বোঝায়।
👉 "সুন্নাত" কখনো নবীর ব্যক্তিগত জীবন বা কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়নি।
🔹 কুরআনে "সুন্নাতুল্লাহ" সম্পর্কিত আয়াতসমূহ এবং বিশ্লেষণ
১. "সুন্নাতুল্লাহ কখনো পরিবর্তন হয় না"
"এটাই আল্লাহর বিধান (সুন্নাতুল্লাহ), যা পূর্বে চলমান ছিল, আর তুমি আল্লাহর বিধানে কোনো পরিবর্তন পাবে না।"
📖 (সুরা আহযাব 33:62)
✅ এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলছে, "সুন্নাত" হলো আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম, যা কখনো বদলায় না।
✅ যদি "সুন্নাত" নবীর ব্যক্তিগত কাজ হতো, তাহলে সেটি বদলাত না? নবীর জীবনে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু আল্লাহর বিধান চিরস্থায়ী।
২. "আল্লাহর সুন্নাত পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রেও কার্যকর ছিল"
"তাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের মধ্যেও আমি এমন শাস্তি দিয়েছি। কারণ, এটাই আল্লাহর সুন্নাত, আর তুমি কখনোই এতে পরিবর্তন পাবে না।"
📖 (সুরা ফাতির 35:43)
✅ এখানে সুন্নাত মানে আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম, যা আগের জাতিগুলোর ক্ষেত্রেও কার্যকর ছিল।
✅ আল্লাহর বিধান অনুসরণ না করলে তাদের ধ্বংস হয়েছে, এটিই আল্লাহর সুন্নাত।
৩. "সুন্নাত মানে আল্লাহর অবধারিত সিদ্ধান্ত"
"যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রাখো, আল্লাহর ইচ্ছা হলো তাদের কিছু পাপের কারণে তাদের বিপদে ফেলা। আর মানুষের জন্য আল্লাহর সুন্নাতে কখনো পরিবর্তন হবে না।"
📖 (সুরা ফাতাহ 48:23)
✅ এখানে "সুন্নাত" মানে আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তির নীতি।
✅ এই নিয়ম চিরন্তন, এটি নবীর ব্যক্তিগত কিছু নয়।
৪. "সুন্নাত মানে জাতির ভাগ্য নির্ধারিত করার নীতি"
"তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে দেখে না, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণতি কী হয়েছে? অথচ তারা ছিল তাদের চেয়ে শক্তিশালী! আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে কিছুই আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারে না। নিশ্চয়ই, এটি আল্লাহর সুন্নাত, আর তুমি কখনোই এতে পরিবর্তন পাবে না।"
📖 (সুরা মুমিন 40:85)
✅ এখানে "সুন্নাত" মানে জাতির উত্থান-পতনের বিধান।
✅ যে জাতি সত্য থেকে দূরে যাবে, তারা ধ্বংস হবে – এটিই সুন্নাতুল্লাহ।
🔹 "সুন্নাতুল্লাহ" ও নবীর ব্যাপারে ভুল ধারণা
❌ অনেকেই বলে, "সুন্নাত মানে নবীর জীবনপদ্ধতি" – কিন্তু কুরআনে নবীর জীবনের জন্য "সুন্নাত" শব্দটি কোথাও ব্যবহৃত হয়নি।
🔹 কুরআনের দৃষ্টিতে নবীর ভূমিকা কী?
"আর রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া।"
📖 (সুরা মায়েদা 5:99)
✅ নবীর কাজ কুরআনের বিধান প্রচার করা, নতুন বিধান তৈরি করা নয়।
🔹 উপসংহার: কুরআনের দৃষ্টিতে "সুন্নাত"
➡ সুতরাং, কুরআনের ভিত্তিতে "সুন্নাত" বলতে শুধুমাত্র "সুন্নাতুল্লাহ" বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান ও নীতি। নবীর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

No comments:
Post a Comment