প্রচলিত নামাজ কেন কুরআনের সালাত নয়?
প্রচলিত নামাজ এবং কুরআনের সালাতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত নামাজ একটি নির্দিষ্ট শারীরিক ও কণ্ঠগত ক্রিয়ার সমষ্টি, যা মূলত পাঁচ ওয়াক্ত নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা হয়। অন্যদিকে, কুরআনে যে "সালাত কায়েম" করার কথা বলা হয়েছে, সেটি কেবল কিছু শারীরিক কর্মকাণ্ড নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা ন্যায়বিচার, সত্যের প্রতি সংযুক্তি, সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত।
১. কুরআনে সালাতের সংজ্ঞা এবং প্রচলিত নামাজের সংজ্ঞা এক নয়
কুরআনের সালাত:
কুরআন যখন সালাত কায়েমের কথা বলে, তখন সেটার উদ্দেশ্য হলো—
- ফাহশা (অশ্লীলতা) ও মুনকার (অন্যায়) থেকে বিরত রাখা (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
- সত্যের সাথে সংযুক্ত থাকা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা (সূরা মাঈদা ৫:৫৫)
- যাকাত দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা (সূরা হজ্জ ২২:৪১)
প্রচলিত নামাজ:
- একটি নির্দিষ্ট নিয়মে পাঁচ ওয়াক্ত পড়া হয়।
- আরবি ভাষায় নির্দিষ্ট কিছু সূরা ও দোয়া মুখস্থ বলা হয়।
- শারীরিক কার্যক্রম (রুকু, সেজদা) করা হয়।
- নামাজের মূল উদ্দেশ্য বোঝার প্রয়োজন নেই, শুধু নিয়ম মেনে পড়লেই যথেষ্ট মনে করা হয়।
২. সালাত মানে শুধু কিছু নির্দিষ্ট বাক্য মুখস্থ করে পড়া নয়
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
"সালাত কায়েম করো আমার স্মরণে।" (সূরা ত্বাহা ২০:১৪)
এখানে স্মরণ (ذِكْرِي) বলা হয়েছে, যা শুধুমাত্র মুখস্থ কিছু পড়া নয়। বরং এটি আত্মিকভাবে সংযুক্ত থাকা ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা করা বোঝায়। প্রচলিত নামাজ কেবল নির্দিষ্ট কিছু শব্দ উচ্চারণের ওপর নির্ভরশীল, যা মূলত মনের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেয়ে নিয়ম রক্ষার দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
৩. কুরআনের সালাতের উদ্দেশ্য আর প্রচলিত নামাজের বাস্তবতা এক নয়
কুরআন বলে—
إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ
"নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে।" (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)
➡ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, অনেক নামাজি মানুষও দুর্নীতি করে, মিথ্যা বলে, অন্যায় করে। তাহলে প্রশ্ন হলো—এই নামাজ কি কুরআনের সালাত হতে পারে? যদি নামাজ সালাত হতো, তাহলে তা সমাজের মানুষকে সত্য ও ন্যায়বিচারের পথে রাখার কথা।
➡ কুরআনের সালাতের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু যারা নামাজ পড়ে, তারা অনেক সময়ই সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কিছু বলে না, বরং শুধু নামাজ আদায় করাকেই যথেষ্ট মনে করে।
৪. কুরআনের সালাত মানে শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং সামাজিক সিস্টেম
কুরআন যখন সালাত কায়েমের কথা বলে, তখন সেটাকে ব্যক্তিগত ইবাদত হিসেবে সীমাবদ্ধ করেনি। বরং সমাজের ন্যায়বিচার ও সুশাসনের সাথে একে যুক্ত করেছে।
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ
"যাদেরকে আমরা পৃথিবীতে ক্ষমতা দিয়েছি, তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, ভালো কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ নিষেধ করে।" (সূরা হজ্জ ২২:৪১)
➡ এখানে সালাতের সাথে যাকাত, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ নিষেধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত নামাজ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদত হিসেবে চর্চা করা হয়, যেখানে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না।
৫. কুরআন সালাতকে ব্যক্তিগত রিচুয়াল হিসেবে চিত্রিত করেনি
প্রচলিত নামাজ একটি ব্যক্তিগত রিচুয়াল, যা নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে পালন করা হয়। কিন্তু কুরআন সালাতকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা সম্পর্ক স্থাপন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন।
وَالَّذِينَ يُمَسِّكُونَ بِالْكِتَابِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ
"যারা কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এবং সালাত কায়েম করে।" (সূরা আ’রাফ ৭:১৭০)
➡ এখানে সালাত মানে কিতাব (কুরআন) মেনে চলার একটি ব্যবস্থা। কিন্তু প্রচলিত নামাজে আমরা দেখি, অনেকেই কুরআনের নির্দেশনা অনুসরণ না করেও নামাজ পড়ে চলে।
৬. সালাত কায়েম মানে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, যা প্রচলিত নামাজের মাধ্যমে সম্ভব হয় না
কুরআন বলে, সালাত কায়েম করতে হলে সত্যের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে এবং অন্যায় প্রতিরোধ করতে হবে।
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ
"সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং নত হও নত হওয়াদের সাথে।" (সূরা বাকারা ২:৪৩)
➡ এখানে সালাতের সাথে যাকাত এবং সমাজের সাথে সংযুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, প্রচলিত নামাজ মানুষকে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন করে না।
উপসংহার: কেন প্রচলিত নামাজ কুরআনের সালাত নয়?
- ১. সালাত মানে শুধু কিছু নির্দিষ্ট বাক্য মুখস্থ করে পড়া নয়, বরং এটি সত্যের সাথে সংযুক্ত হওয়া।
- ২. কুরআনের সালাত নৈতিকতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা, যা প্রচলিত নামাজে অনুপস্থিত।
- ৩. সালাত মানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, যা প্রচলিত নামাজের মাধ্যমে সম্ভব হয় না।
- ৪. সালাত মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে রাখার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে নামাজি মানুষও অনেক সময় অন্যায় করে।
- ৫. সালাত মানে কুরআনের বিধান মেনে চলা, যা প্রচলিত নামাজের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।
No comments:
Post a Comment