ফিতর শব্দের রুট ও প্রকৃত অর্থ
"ফিতর" (فطر) শব্দটি মূলত আরবি রুট "ف-ط-ر" (Fa-Ta-Ra) থেকে এসেছে। এর মৌলিক অর্থ হলো ভাঙা, বিদীর্ণ করা, কাটা বা কিছু প্রথমবার সৃষ্টি করা। এটি এমন কিছুকে বোঝায় যা আগে অক্ষত ছিল এবং হঠাৎ করে আলাদা হয়ে গেছে বা নতুনভাবে উদ্ভূত হয়েছে।
কোরআনে ফিতর শব্দের ব্যবহার
কোরআনে "فطر" শব্দমূল থেকে নির্গত বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো—
1. سورة الإنفطار (আস-ইনফিতার) 82:1
إِذَا ٱلسَّمَآءُ ٱنفَطَرَتْ
"যখন আকাশ বিদীর্ণ (ফাটল) হবে।"
এখানে "انفطرت" এসেছে "فطر" থেকে, যার অর্থ বিদীর্ণ হওয়া বা ফেটে যাওয়া।
2. سورة الأنعام (আল-আন'আম) 6:79
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ
"নিশ্চয়ই আমি আমার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি তাঁর দিকে, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।"
এখানে "فطر" শব্দটি সৃষ্টি করা বা প্রথমবার আকার দেওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
3. سورة عبس (আবাসা) 80:26
ثُمَّ شَقَقْنَا ٱلْأَرْضَ شَقًّۭا فَأَنۢبَتْنَا فِيهَا حَبًّۭا
"অতঃপর আমরা জমিনকে ফাটিয়ে দিলাম এবং এতে শস্য উৎপন্ন করলাম।"
যদিও এখানে "شق" (শাক্কা) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু অর্থগতভাবে এটি "ফিতর" এর মতোই ফাটিয়ে দেওয়া বা বিদীর্ণ করা বোঝায়।
বাস্তবিক উদাহরণ
1. প্রাকৃতিক উদাহরণ:
বীজ থেকে গাছ: যখন একটি বীজ মাটির নিচে থাকে, এটি প্রথমে ফেটে যায় এবং অঙ্কুর গজায়। এটিই প্রকৃত "ফিতর"।
ভোরের আলো: রাতে অন্ধকার থাকে, কিন্তু ভোর হওয়ার সময় আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, যা বিদীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া বোঝায়।
2. মানুষের জীবন থেকে উদাহরণ:
একটি নতুন আইডিয়া: আপনি যখন কোনো নতুন ধারণা প্রথমবার প্রকাশ করেন, তখন সেটি মানসিকভাবে "ফিতর" হয়—অর্থাৎ এটি আপনার মস্তিষ্ক থেকে প্রকাশিত বা বিদীর্ণ হয়।
একটি ডিম ফেটে বাচ্চা বের হওয়া: ডিমের খোলস ফেটে যখন বাচ্চা বের হয়, তখন এটি প্রকৃত "ফিতর" এর উদাহরণ।
উপসংহার ; "ফিতর" শব্দটি মূলত কোনো কিছুর ফেটে যাওয়া, বিদীর্ণ হওয়া বা নত করে সৃষ্টি হওয়া বোঝায়। এটি কোরআনে সৃষ্টি, পরিবর্তন, নতুনত্ব এবং বিদীর্ণ হওয়ার সাথে সম্পর্কিত অর্থে এসেছে।
ঈদের আগে ফিতরা দেওয়া কি কুরআনসম্মত?
প্রচলিত ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈদের আগে ফিতরা দেওয়া হয়, যাকে "সদকাতুল ফিতর" বলা হয়। এটি মূলত রোযা (সিয়াম) শেষে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণের জন্য নির্ধারিত একটি দান হিসেবে ধরা হয়। তবে প্রশ্ন হলো— এই ফিতরা কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না?
কুরআনে "ফিতরা" সম্পর্কিত কোনো বিধান আছে কি?
কুরআনে সরাসরি "সদকাতুল ফিতর" নামে কোনো বিধান নেই।
তবে দান বা ইনফাক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আছে—
1. প্রয়োজনের অতিরিক্ত থেকে ব্যয় করতে বলা হয়েছে:
سورة البقرة 2:219"তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলো: প্রয়োজনের অতিরিক্ত অংশ।"
এখানে বলা হয়েছে, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত তা দান করতে হবে। এটি কোনো নির্দিষ্ট দিনে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
2. গরিব ও অভাবীদের জন্য সম্পদ বণ্টনের নির্দেশনা:
سورة الذاريات 51:19
"তাদের সম্পদে প্রার্থীর এবং বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।"
অর্থাৎ, ধনীদের সম্পদে গরিবদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে, তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ নয়।
উপসংহার
করআনে "সদকাতুল ফিতর" নামে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই, বরং দরিদ্রদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে সাধারণভাবে, নির্দিষ্ট দিনে নয়।
যদি কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ দান করে, তাহলে তা কুরআনের নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু যদি ঈদের আগেই দান করাকে বাধ্যতামূলক করা হয় এবং নিরদিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে এটি কুরআনসম্মত নয়, বরং
এটি একটি প্রচলিত সামাজিক ও ঐতিহ্যগত রীতি।
No comments:
Post a Comment