হিকমাহ
হিকমাহ (الحِكْمَة) – কুরআনের আলোকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ
১. পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট
অনেক প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা হয়, "হিকমাহ মানে হলো হাদীস"।
তবে কুরআনে হিকমাহ শব্দটি এসেছে বহুবার, এবং প্রতিবারেই এর ব্যবহার অন্যরকম, গভীর এবং হাদীসের সাথে সম্পর্কহীন এক অর্থ বহন করে।
২. হিকমাহ শব্দের রুট বিশ্লেষণ
রুট অক্ষর:
ح ك م (ḥ-k-m)
এই রুট থেকে উদ্ভূত শব্দগুলো:
শব্দ | অর্থ |
---|---|
حَكَمَ | বিচার করা, ফয়সালা দেওয়া |
حُكْم | রায়, বিধান |
حَكِيم | প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ |
مُحْكَم | সুসংবদ্ধ, নির্ভুল |
حِكْمَة | প্রজ্ঞা, যুক্তিসংগত জ্ঞান, গভীর চিন্তা |
মূল ধারণা:
এই রুট সবসময় বোঝায় ন্যায়ভিত্তিক রায়, ভারসাম্যপূর্ণ বিচার, গভীর প্রজ্ঞা ও যুক্তিসংগত চিন্তা।
৩. কুরআনে হিকমাহ এর ব্যবহার
> কুরআনে হিকমাহ শব্দটি এসেছে ২০+ বার। নিচে গুরুত্বপূর্ণ ১২টি আয়াত উপস্থাপন করা হলো:
১. আল-বাকারা 2:129
وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিবেন…”
২. আল-বাকারা 2:151
كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا… يُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…তিনি (রাসূল) তোমাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন…”
৩. আল-বাকারা 2:231
وَأَنزَلَ اللَّهُ عَلَيْكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…আল্লাহ তোমাদের প্রতি কিতাব ও হিকমাহ নাযিল করেছেন…”
৪. আল-বাকারা 2:269
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ…
“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিকমাহ দেন, আর যাকে হিকমাহ দেওয়া হয়, তাকে বিশাল কল্যাণ দেওয়া হয়।”
৫. আলে ইমরান 3:48
وَيُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“তিনি ঈসা (আঃ)-কে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন…”
৬. আলে ইমরান 3:164
رَسُولًا… يُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…তিনি তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন…”
৭. আন-নিসা 4:54
فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“আমরা ইব্রাহিমের বংশকে কিতাব ও হিকমাহ দিয়েছিলাম।”
৮. আন-নিসা 4:113
وَأَنزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাহ নাযিল করেছেন…”
৯. আল-মায়েদাহ 5:110
وَإِذْ عَلَّمْتُكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“…আমি তোমাকে (ঈসা) কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিয়েছিলাম…”
১০. আল-নাহল 16:125
ادْعُ إِلِىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ
“তোমার রবের পথে হিকমাহ দিয়ে আহ্বান কর…”
১১. বনি ইসরাইল 17:39
مِمَّا أَوْحَىٰ إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ
“তোমার প্রতি ওহী করা হিকমাহ…”
১২. লুকমান 31:12
وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ
“আমরা লুকমানকে হিকমাহ দিয়েছিলাম…”
৪. প্রচলিত ভুল ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ
ভুল ব্যাখ্যা:
অনেক হাদীসপন্থী বলেন —
> “হিকমাহ মানেই হচ্ছে হাদীস।”
কিন্তু বাস্তবতা হলো:
কুরআনে কখনোই হিকমাহ = হাদীস বলা হয়নি।
ইয়াহইয়া, ঈসা, লুকমান, দাউদ— এদের সবাইকে হিকমাহ দেওয়া হয়েছিল, অথচ তাদের সাথে কোনো হাদীস সংকলন নেই।
কুরআনে কোথাও “হিকমাহ মানেই হাদীস” এমন দাবি করা হয়নি। বরং তা আল্লাহপ্রদত্ত চিন্তার পরিপক্বতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও ন্যায়বিচার বোঝায়.
৫. হিকমাহ এর প্রকৃত কুরআনিক ব্যাখ্যা
প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী:
-
হিকমাহ মানে হাদীস।
-
রাসূল (সঃ)-এর মুখনিঃসৃত কথা ও কাজই হিকমাহ।
-
কুরআনের বাইরে হিকমাহ বোঝার জন্য হাদীসই একমাত্র উৎস।
কুরআনিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী:
-
হিকমাহ মানে – বিচারক্ষমতা, যুক্তি, প্রজ্ঞা ও চিন্তার ভারসাম্য।
-
এটি আল্লাহর দেওয়া এমন এক জ্ঞান যা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে।
-
কিতাবের পাশাপাশি আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিকমাহ দেন (২:২৬৯)।
-
ঈসা, লুকমান, দাউদ, ইব্রাহিম, রাসূল— সবাইকে হিকমাহ দেওয়া হয়েছিল, অথচ তাদের কোনো হাদীস ছিল না।
-
হিকমাহ শিক্ষা দেওয়ার কাজটি ছিল রাসূলের দায়িত্ব (২:১২৯, ৩:১৬৪), কিন্তু হিকমাহ মানেই হাদীস নয়।
-
হিকমাহ হলো ওহীভিত্তিক চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তা, যা কুরআনের মাধ্যমেই শেখানো হয়।
-
হিকমাহ হলো এক প্রকার ‘আন্তর্জাতিক জ্ঞান’— যা কেবল মুমিনদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় (যেমন লুকমান ছিলেন নবীও নন, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে হিকমাহ দিয়েছেন)।
৬. উপসংহার
"الحِكْمَة (হিকমাহ)" মানে হাদীস নয়।
বরং এটি এমন এক আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞান, যা মানুষকে সঠিক-ভুল, ন্যায়-অন্যায়, যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে।
এটি কুরআন থেকেই শেখার জ্ঞান।
> আল্লাহ বলেন:
“যাকে হিকমাহ দেওয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেওয়া হয়।” (২
:২৬৯)
হিকমাহ (حِكْمَة) কুরআনে আল্লাহর দেওয়া একটি গুণ, যা প্রকৃত বোধ, তত্ত্ব, বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক গভীর রূপ। এটি কাউকে 'দেওয়া' হয়, যেমন:
> "يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا"
“যাকে ইচ্ছা তিনি হিকমাহ দেন; আর যাকে হিকমাহ দেওয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণই দেওয়া হয়েছে।”
— [সূরা বাকারা ২:২৬৯]
এখন, যদি কেউ বলে হিকমাহ মানে "হাদিস", তাহলে প্রশ্ন হয়:
কোন হাদিস? — বোখারি? মুসলিম? মালেক? তিরমিজি?
আর তখনই প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে যায়:
> "হিকমাহ তুমি কার? বোখারির নাকি মালেক আঙ্কেলের??"
যদি হিকমাহ কুরআনের মতোই বিশুদ্ধ, ওহীভিত্তিক এবং আল্লাহ-প্রদত্ত হয়, তবে সেটা কোনো মানুষের নামে ব্র্যান্ডেড হওয়া সম্ভব না—না বোখারি, না মালেক।
বরং কুরআনের রূটে ফিরে গেলে ‘হিকমাহ’ (Root: ḥ-k-m) মানে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা, যা কুরআন নিজেই শেখায়।
তাই হিকমাহ আল্লাহর—কারও আঙ্কেলের না।
No comments:
Post a Comment